ধারাবাহিক উপন্যাসঃ নাইয়র (পর্ব-ছয়)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৭:৩৯:৪৪ সকাল
৬.
দেখতে দেখতে শীতকাল চলে গেলো। ধান কাঁটার পরে গ্রামের ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব... মায়েরা বিভিন্ন ধরনের পিঠা-পুলির আয়োজন করেছে। গ্রামীন জীবনে এক ধরণের রিল্যাক্সেশন চলবে ফাল্গুন- চৈত্র এই দু'মাসে।বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ এখন পুরোটাই খালি। ধান কেটে নেবার পরে অবশিষ্টাংশ 'নাড়া' রয়ে গেছে। এগুলো ধীরে ধীরে রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে পচে যায়। জমির উর্বরতা বাড়ানোর এটা এক প্রাকৃতিক উপায়। এ সময় ছেলেপুলেরা খোলা মাঠে ফুটবল খেলে থাকে। কোনো কোনো যায়গায় ক্রিকেটেরও চল রয়েছে। অবশ্য আমাদের বাংলাদেশীদের মনস্তত্ব বোঝা বড়ই মুশকিল। ক্রিকেট বিশ্বকাপ বা টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের সময়ে সবাই ক্রিকেট নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। আবার ফুটবল বিশ্বকাপের সময় এলে ফুটবল জ্বরে আক্রান্ত হবে। নিজেদের ভালোলাগার দিক চিন্তা করে এরা কিছুই করবে না। এ যেন ঝোপ বুঝে কোপ মারার মত অবস্থা।
শ্রীরামকাঠী গ্রামের তরুনসংঘ ক্লাবের উদ্যোগে এলাকার ছেলেরা একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করতে চাইলো। সবাই মিলে চেয়ারম্যান মোতাহারের অফিসে ভীড় করে। এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চাইছে ওরা। একটা সমস্যাও রয়েছে, সেটার সমাধানও হবে। আবার কিছু 'ডোনেশন'ও পাওয়া যাবে। শহরের গণ্ডী ছাড়িয়ে এই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে চাঁদা আদায়ের প্রথা এখন অজপাড়া গাঁয়েও পৌঁছেছে।
সমস্যা হল প্রতি বছর বাজারের পিছনের 'কোলায়' ঘোড় দৌড়ের আয়োজন হয়ে থাকে। সাথে একটি মেলারও। মেলা কয়েকদিন ব্যাপী হয়। আশে পাশের কয়েক গ্রামের মানুষ সেখানে ভীড় করে। এই সুযোগে কিছু ব্যবসাও হয়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা তাদের পসরা নিয়ে হাজির হয়। ভ্রাম্যমান বিক্রেতারাও অল্প পুঁজি খাটিয়ে মোটামুটি কিছু সঞ্চয় করে নেয়। এরপর রয়েছে মেলার ডাক (নিলাম) নেয়া। এখানেও চলে অনেক টাকার লেনদেন। আর ঘোড়ার দৌড়ের উপর বেইট ধরা মানে বাজী ধরা আসলে প্রকাশ্যে একধরণের জুয়া খেলারই নামান্তর। তবে এটা ভদ্র লোকেদের- বনেদী ঘরানার জুয়া হওয়াতে কারো চোখে তেমন বাঁধে না। হাউজি খেলারও ব্যবস্থা হয়। এখন আর গ্রাম কি সেই হ্যারিকেনের মিটমিট আলোর গ্রাম রয়েছে! পল্লীবিদ্যুতের কল্যানে ঘরে ঘরে টেলিভিশন। এমনকি বাজারের এক ঘর থেকে ডিশ ব্যবসাও চালু হয়েছে। সন্ধ্যার পরে এখন প্রায় ঘরেই স্টার জলসা দেখে। না হয় হিন্দী সিরিয়ালের ছড়াছড়ি। তার ভিড়ে দেশী চ্যানেলগুলো আজকাল ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো অসহায়।
এই মেলাকে কেন্দ্র করে আরো একটা চক্র সরাসরি জুয়ার আসর বসায়। দু'ধরণের আসর বসে। তাসের এবং অন্যটা চরকা'র। তবে এই আসর বসাতে মেলা কমিটি এবং লোকাল থানার অনুমতি লাগে। আর আমাদের দেশের কতৃপক্ষগুলো এতোটাই পচে গেছে- টাকার বিনিময়ে উলঙ্গ হতেও দ্বিধা করেনা। তাই এই দুই কতৃপক্ষকে ম্যানেজ করে জুয়ার এই আসর বসানোটা একেবারে মামুলি ব্যাপার। এলাকার যুবক ছেলেদের টার্গেট থাকে এই আসরটির প্রতি। আর সেখানে খেলতে গিয়ে ঘটে বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা। মারামারি পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর নেশাটা এমনই যে, ঘর থেকে হালের বলদ পর্যন্ত নিয়ে বিক্রী করেছে এমন ঘটনাও শোনা গেছে। তাই অভিভাবকেরা এই মেলার সময় এলেই খুব ভয়ে ভয়ে থাকে। এবার নাকি পুতুল নাচের আসর বসাবে শোনা যাচ্ছে। এইটা আর এক অসামাজিক কাজ। এই পুতুল নাচের আড়ালে আসলে চলে বাজারি কিছু মেয়েদের এনে উলঙ্গ ড্যান্স। যেটাকে অনেকে 'ভ্যারাইটি শো ' নামে চিনে।
মোতাহারের কাছে এবার তরুণেরা মেলার এই মাঠকে ফুটবল টুর্নামেন্টের জন্য চেয়ে বসলো। এলাকার সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত সোহেল মনুর নামে এবার তারা একটি গোল্ড কাপ টুর্ণামেন্ট রাখতে চাচ্ছে। এই ইউনিয়নের সব ক'টি গ্রাম এই খেলায় অংশ গ্রহন করবে। প্রাথমিকভাবে ওদেরকে মোতাহার কোনো কথা দেয় না। এলাকার আরো গন্যমান্যদের সাথে আলাপ করে সে জানাবে বলে ওদেরকে বিদায় করে দেয়। আর নিজের থেকে মোটা একটা ডোনেশন দেবারও প্রতিশ্রুতি দেয়।
সেদিন সন্ধ্যায়...
শিকদার বাড়ির কাছারি ঘরে সবাই সমবেত হয়েছে। দুষ্ট চক্রের সকল সদস্য, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার প্রতিনিধি হিসাবে একজন এস. আই এসেছেন। সন্তোষ মন্ডল কিছুটা অসুস্থ থাকায় আসতে পারেন নি। তার বড় ছেলে পরিমল মন্ডল এসেছে।আজ পারুল এখানে নেই। সে এলাকার এক প্রসূতি মেয়ের অবস্থা সিরিয়াস হয়ে যাওয়াতে তাকে নিয়ে পিরোজপুর সদর হাসপাতালে গেছে। সাথে কবি মুজিবরও রয়েছে। মোতাহার মনে মনে খুব একা বোধ করে। একজন পারুলের অভাব ওকে এতোটা বিষন্ন করে দেবে, সে কি ভেবেছিল কখনো?
ক্লাবের সেক্রেটারি ই কথাটা তোলে। সে সরাসরি জানায় এবার ঘোড় দৌড়ের মাঠ তাদেরকে দিতে হবে। মনু চেয়ারম্যানের নামে ফুটবল টুর্নামেন্টের জন্য মাঠ দরকার। আর আশে পাশে এই যায়গাটা ছাড়া ভালো কোনো মাঠও নেই। মালেক শিকদার বলে, ' অসম্ভব। প্রতিবারই এই সময়ে এই যায়গায় এই মেলা হয়ে আসতেছে। তোমরা স্কুলের মাঠে খেলো না কেন?' সেক্রেটারি সালাম এটা শুনে একটু রাগ হয় । কিন্তু ওর বাপও এখানে রয়েছে দেখে একটু নরম স্বরে বলে, ' চাচা, ঐ মাঠে তো ছোড পোলাপানেরাও খেলতে পারবে না। আর একবার কিক করলে বল খাল পার হইয়া ওপার ধান ক্ষেতের ভিতর। আমাগো বাজারের পিছনের মাঠ-ই চাই।'
মালেক শিকদার এবং কোব্বাত মিয়া মেলা কমিটির অন্যতম সদস্য। তবে এই মেলার সকল খরচ যেটাকে ইনভেস্ট বলতে পারি, বহন করে দুজন। হাবিব মুন্সী এবং মালেক শিকদার। কিন্তু হাবিব মুন্সী খুব গভীর জলের মাছ। সে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে। অন্তত এই ব্যাপারটিতে। তাই কোব্বাত মালেক শিকদারের কথাতে সমর্থন দেয়। থানার এস. আইও মেলার পক্ষে কিছুটা সুর নরম করে। না করেও বা উপায় কি। ওদের থানার পুলিশ সদস্যদের জন্য এই মেলা বেশ একটা উপরি আয়ের ব্যবস্থা করে আসছে প্রতি বছর। তাই তারা সব সময়েই মেলার আয়োজকদের পক্ষেই থাকবে।
একটা কলহ বাঁধার উপক্রম হয়েছে দেখে মোতাহার খুব বিব্রত বোধ করে। কীভাবে এর সুরাহা করা যায় সেটাই ভাবতে থাকে। বর্ষীয়ান জয়নাল চাচার দিকে তাকায়। তিনি কি দিতে পারবেন এর কোনো সমাধান? নাকি হাই স্কুলের হেডমাস্টার যতীন স্যারকে বলবে কিছু বলার জন্য। একসময় বাধ্য হয়ে মোতাহার সবাইকে চুপ থাকতে বলে। মুরব্বীদের সম্মানার্থে সে উঠে দাঁড়ায়। এরপর বলতে থাকে, ' আসলে আমরা একটা কঠিন সমস্যার সামনে রয়েছি। প্রতি বছর এখানে এই মেলা হয়ে আসছে। এটা আমাদের জন্য অন্য গ্রামের তুলনায় একটা গর্বের ব্যাপার। একটা পুরনো ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে এই মেলাকে ঘিরে। তাছাড়া মেলার ডাকে যে পরিমান টাকা পাওয়া যায় তা আমাদের বাজারের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা সারা বছর এই মেলার দিকে চেয়ে বসে থাকে। তাই অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে মেলা যথা সময়ে হওয়াটা উচিত।'
মোতাহারের কথা এই পর্যন্ত শুনেই তরুণেরা গুঞ্জন তোলে। তবে তারা যে রুষ্ট হয়েছে এটা বোঝা যায়। মোতাহার আবারো তাদেরকে চুপ করিয়ে তাঁর কথা চালু রাখে, ' তবে এবারে মেলা সাত দিনের যায়গায় চার দিন হবে। আর ফুটবল টুর্নামেন্ট মেলার পরেই আমরা শুরু করবো।'
মালেক শিকদার ও কোব্বাত মিয়া খুশী হয়। হাবিব মুন্সীর চেহারায় কোনো ভাব ফুটে উঠে না। মোতাহার আবার সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, ' আর একটা কথা, এবারে মেলায় কোনো প্রকার জুয়ার বোর্ড বসবে না। কোনো পুতুল নাচের আড়ালে ভ্যারাইটি শো হবে না। অন্তত আমি যতদিন চেয়ারম্যান রয়েছি এটা হতে দেবো না। এ ছাড়া আর সব ধরনের সব কিছু চলতে পারবে।'
অভিভাবকেরা মনে মনে খুশী হয়। তাঁদের চেহারায় সেটা প্রকাশ পায়। যেভাবে দুষ্ট চক্রের হাবিব মুন্সী ছাড়া বাকীদের ম্লান চেহারায় অখুশিটা প্রকাশ পায়। কিন্তু এই অসামাজিক কাজটা তো আর প্রকাশ্যে সবার সামনে করতে চাওয়ার আবদারও করা যায় না। তাই বুকের দুঃখ বুকে নিয়েই মালেক শিকদারদের সভা শেষে বেরিয়ে যেতে হয়।
কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো এলাকাটিকে লাল ফুলের গালিচায় পরিণত করেছে। গাছের তলায় এই রঙিন গালিচা। কোকিল ডাকা এই ফাল্গুন মাসের অফুরন্ত বিশ্রামের সময়টা গ্রামবাসীরা অলস আড্ডায় কাটাতে চায়। হাতে এখন টাকা রয়েছে। কেউ কেউ মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসে। সাথে করে মেয়ে-জামাইকেও নিয়ে আসে কেউ কেউ। বসন্ত এলে মৃদুমন্দ বাতাসে এলাকার মানুষের ঘুম এবং ক্ষুধাও কেন জানি বেড়ে যায়। পড়ন্ত দুপুরে খালের পাড়ে যে কোনো গাছতলায় যে কেউ একটা গামছা বিছিয়ে শুয়ে থাকে।এমন নিশ্চিন্তের ঘুম অন্য কোথায়ও দেখা যায় না। মানুষের মনও এইসময় অন্য সময়ের তুলনায় বেশী নরম থাকে। তাই মেলা, ঘোড় দৌড় এসবের আড়ালে এক ধরণের ফড়িয়া বা ফাটকাবাজেরা গ্রামের এই সহজ সরল মানুষদের থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিতে চায়।
এটাই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। কারণ বিনোদনের আর যে কোনো রাস্তাই খোলা নেই এদের জন্য। অবহেলিত এরাই যে আমাদের শেকড়- সে কথা কি আমাদের নগরকেন্দ্রিক পিতারা কখনো ভাবেন?
না ভাবতে চান!
... ... ...
ব্যাপারি বাড়িতে শোকের ছায়া।
সাধারণত গ্রামের এক বাড়িতে শোক অন্যদেরকেও শোকাতুর করে ফেলে। শহরের মত না যে পাশাপাশি দুই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা একজন অন্যজনকে চেনেও না। যাওয়া-আসার সময় যাও-বা দেখা হয়, কিন্তু কে যে কোন বাসার মানুষ তা বুঝে উঠেতে পারেনা।
গতকাল পারুল রফিক ব্যাপারির ছেলের বউকে পিরোজপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থায়। সে সন্তান সম্ভবা ছিল। কিন্তু তাঁকে নিয়মিত চেক আপ করানো হয়নি। গ্রামের ধাই আর প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা হুজুরের পানি পড়ার উপরেই চলছিল গত মাসখানেক ধরে। আসলে শহরের সাথে তাল মিলিয়ে গ্রামের অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও কিছু কিছু জিনিস এখনো প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতেই রয়ে গেছে। এরা নিজেদের ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য এখনো অনেক কিছুকে চালু রেখেছে। এদের কাছে নতুন কিছু মানেই প্রথমে তা ধর্মের কষ্টিপাথরে যাচাই-বাছাই এবং সেটা আবার তাদের স্বার্থের অনুকূলও হতে হবে। তবেই না তারা সেটাকে অনুমোদন দেয়।
পারুল আজ সকালে ব্যাপারির ছেলের বউ এর লাশ নিয়ে গ্রামে ফিরেছে। মা এবং শিশু- কাউকেই ডাক্তাররা বাঁচাতে পারেনি। ডাক্তারদের সাথে কথা বলে পারুল জানতে পারে যে, কয়েকদিন ধরে ইন্টারন্যালি ব্লিডিং হচ্ছিল। কিন্তু সেটাকে গুরুত্ব না দেয়ায় ইনফেকশন হয়ে যাওয়াতে কাউকেই বাঁচানো যায়নি। মেয়েটির নাম ছিল ছালেহা।
পারুল গ্রামে এসে ছালেহার শ্বাশুড়িকে ডেকে মোটামুটি সব তথ্য জেনে নেয়। ওগুলো শুনে একাধারে সে রাগ হয় এবং মনে মনে কষ্ট পায়। বিজ্ঞানের এতোটা উন্নতির পরও এখনো মানুষ ডাক্তারদের কাছে যেতে চায়না... একটা প্রাচীন সামাজিক সিস্টেমের গোলকধাঁধায় পরে যেতে পারেনা! আশ্চর্য!
ছালেহার শ্বাশুড়ি জানায় তারা উপজেলা কমপ্লেক্সে ছালেহাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু এর আগে হাবিব মুন্সীর কাছ থেকে বাচ্চা ও মায়ের সুস্থতার জন্য পানি পড়া নিতে গেলে সে ছালেহার শ্বশুরকে ডাক্তারের কাছে যেতে নিষেধ করে। গ্রামের অন্য মহিলাদের ডেলিভারীর দিকটি দেখিয়ে সে বলেছিল, সবারই তো যার যার ঘরে ধাই এর দ্বারা সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। উপজেলার পুরুষ ডাক্তারের কাছে গেলে আব্রু থাকবে না ইত্যাদি ইত্যাদি বলে তাদেরকে নিবৃত করে। আর হাবিব মুন্সীর কথা না শুনলে সমাজে ওদেরকে এক ঘরে করে রাখা হতো। কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো তিনি বলছিলেন আর কাঠ হয়ে পারুল তাঁকে সান্ত্বনা দিতে দিতে শুনছিল। পারুলের মনের ভিতর একটা নতুন আইডিয়ার জন্ম হয়। সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়। এবং এই মৃত্যুর জন্য গ্রামের এই ফতোয়াবাজ হাবিব মুন্সী গংদের বিরুদ্ধে কার্যকর একটা ব্যবস্থা নেবার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে।
সেদিন রাতে পারুলের ঘুম হয়না। বার বার ছালেহার কথা মনে পড়ে। ওর রুমের মধ্যে সে পায়চারি করতে থাকে। দুবার ভীষণ তেষ্টা পেতে পানি খায়। কিন্তু পানির স্বাদও ওর কাছে বিস্বাদ লাগে। ভোর হবার অপেক্ষায় থাকে সে। দিনের কথা মনে পড়ে ওর... আসরের নামাজের পর ছালেহার জানাজা হয়ে গেলে নবজাতক সন্তান সহ ওদের দুজনকে আলাদা ভাবে কবর দেয়া হয়। এইরূপ অনাকংখিত মৃত্যুতে গ্রামবাসী নিজেদের চোখের পানি সামলাতে পারে না। ছালেহার স্বামী পাগলপ্রায় হয়ে বলছিল, ‘ হায় আল্লাহ! আমার সোনামনি ওর মায়ের সাথে কবরেও থাকতে পারলো না!”
পরেরদিন সকালের দিকে পারুল মোতাহারকে মোবাইলে কল করে... তাঁকে মুজিবরের ক্লাব ঘরে আসতে বলে। সারা রাত না ঘুমানোতে এবং এর আগের দিনের দৌড়াদৌড়িতে সে খুব ক্লান্ত এবং অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ঘন্টাখানেক পরে মোতাহারের বাইকের আওয়াজ শোনা যায়। কৃষ্ণচূড়া গাছটির তলায় সে বাইকটি রেখে ক্লাব ঘরের দিকে আগায়। মুজিবর এবং পারুল ভিতরে চুপচাপ বসে ছিল। মোতাহার ঢুকতেই মুজিবর একমাত্র চেয়ারটি ছেড়ে নিজে পারুলের পাশে খাটের উপরে বসে। মোতাহারের ভিতরে কোথায় যেন ওদের দুজনকে পাশাপাশি বসতে দেখে একটু জ্বলন অনুভব হয়। তবে তা ক্ষনিকের... মনে মনে হেসে সে ওটাকে পাত্তা না দেবার চেষ্টা করে। এই প্রথম পারুল কিছু বুঝতে পারেনা। আসলে সে তখন অন্য চিন্তায় ছিল বলে ওর নজর এড়িয়ে যায় ব্যাপারটি।
মোতাহারকে পারুল ছালেহার ঘটনাটা সব খুলে বলে। শুনতে শুনতে মোতাহার ও মুজিবর প্রথমে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়... পরে হতভম্ব এবং সব শেষে হতাশ হয়। কীভাবে সে এই দুষ্ট চক্রের বিরুদ্ধে গিয়ে এতো সব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করবে সেটা ভেবেই মোতাহার দিশেহারা হয়ে পড়ে। কারণ এবারের ব্যাপারটা অতো সহজ না। এখানে গ্রামের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অনুভূতিকে পুঁজি করে হাবিব মুন্সী খুব সাবধানে এগিয়েছে। মোতাহার যতই স্কুল এবং মেলায় অবৈধ কাজগুলো বন্ধ করে থাকুক না কেন, মেয়েদেরকে প্রসূতিকালীন চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে গেলে ওকে অনেকের সাথেই সংঘর্ষে জড়াতে হতে পারে। কারণ এই বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর। আর প্রতিটি ঘরে ঘরে মায়েরা নিজেদের মেয়েদের কিংবা ছেলের বউদেরকে সন্তান সম্ভবাকালীন ঘরের বাইরে পাঠাতে চায় না। যদিও সেটা ওদের কাছের উপজেলায়ই হোকনা কেন। এ-ই হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।
গ্রামে দুজন ধাই আছে যারাও অনেক অভিজ্ঞ। কিন্তু এরা আসলে নিরাপদ প্রসবের সময়ে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মকেই অনুসরণ করে আসছে। তবে এর বাইরে অবস্থা একটু খারাপের দিকে গেলেই তারা ব্যর্থ হয়। তখন ভাগ্যের উপর, না হয় ‘বাতাস লাগছে’ কিংবা প্রসূতির আগের কোন খারাপ রেকর্ডের উপর দিয়ে দুর্ঘটনার দায় চাপাতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
পারুল ওদেরকে বলে, ‘ হঠাৎ করে আমরা সবাইকে চিকিৎসার জন্য উপজেলায় পাঠাতে পারব না ঠিকই। কিন্তু গ্রামের ভিতরেই ধাইদেরকে ট্রেনিঙের ব্যবস্থা তো করতে পারবো। আর আমি সহ গ্রামের আরো কিছু শিক্ষিত মেয়েরা আছে, তাদেরকেও এই ব্যাপারে ট্রেইনড করা যেতে পারে। এ ছাড়া ভিতরে ভিতরে এরই মধ্যে সবাইকে সচেতন করার কাজটাও চালাতে পারবো।‘
কিছুক্ষণ থেমে সে আরো বলে ‘আমার কাছে হাবিব মুন্সীর বিরুদ্ধে বিজয়ী হবার থেকে আমার গ্রামের মেয়েদের জীবন বাঁচানোটা বেশী জরুরী। প্রয়োজনে আমরা এই ব্যাপারে হাবিব মুন্সীর সাথে একটা ফয়সালায়ও আসতে পারি।‘ মোতাহার মাথা নেড়ে না-বোধক উত্তর দেয়।
তখন মুজিবর বলে, ‘ আমাদের উপজেলায় মহিলা ডাক্তার আনতে পারলে সব থেকে কাজের কাজ হয়। কিন্তু এতো দূরে আর এই অজ পাড়া গাঁয় পুরুষ ডাক্তাররাই আসতে চায়না। ওদের পোষ্টিং হলেও দু’তিন মাসের ভিতরেই টাকা খাইয়ে আবার শহরের দিকে চলে যায়। এই যাওয়া-আসার ভিতরেই পড়ে আছি আমরা। একটা সিস্টেম লস থেকেই যাচ্ছে।‘
পারুলের মুখে হঠাৎ হাসি ফুটে ওঠে। সে বলে, ‘ তোমার কথায় একটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। ঢাকায় আমার পরিচিত কয়েকজন বান্ধবী রয়েছে। এরা আমাদেরকে এই ব্যাপারে হয়তো সাহায্য করতে পারবে। দাড়াও, আমি মোবাইলে ওদের সাথে কথা বলে দেখি। যদি অন্তত একজন মহিলা ডাক্তারকেও ছয় মাসের মতো এখানে রাখতে পারি, এর ভিতরে একটা পথ নিশ্চয়ই আমরা পেয়ে যাবো। মানুষের ভিতরে ডাক্তারের কাছে যাবার ব্যাপারে যে অনীহা সেটাও কেটে যাবে।
একজন রমণী তাঁর গ্রামের কিছু ‘মা' দের জন্য ওর বুকে পরম মমতা অনুভব করে। কিন্তু যুগ যুগ ধরে চলে আসা কিছু সামাজিক প্রথা ওর হাত-পা বেঁধে রেখেছে দেখে প্রচন্ড কষ্ট পায়। এরই মাঝে সে একটা আশার আলো পাওয়াতে সেটাকেই আঁকড়ে ধরতে চায় চরম ভাবে। আর ওর এই আশার সমুদ্রে বৈঠা হাতে দুই তরুন ওর পাশাপাশি থাকতে চায়।
দেখা যাক ওরা কতদূরে ওদের আশার তরীকে নিয়ে যেতে পারে।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১১১৭ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
শুভেচ্ছা আপনার জন্যও।
হ্যা, কল্পনার রাজ্যে অনেকটা হারিয়ে যাই, আর মূল উপাত্তগুলো বাস্তবের গ্রাম থেকে ধার করি- রঙগুলো কল্পনায় বসে মাখাই।
চেষ্টা করছি আকর্ষনীয় করবার জন্য। বাকীটা আল্লাহ পাক জানেন। তিনি তো আমাদের সকলের মনের খবর উদ্রেক হবার আগে থেকেই জানেন।
সাথে থেকে অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
অনেক সুন্দর হচ্ছে,সাথেই থাকছি।
শুভ কামনায়
সাথে থেকে অনুভূতি জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন